১) জীবনস্মৃতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়সংক্ষেপ আলোচনা কর।
স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহাকিছু ঘটিতেছে, তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি-অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড়ো করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।
এইরূপে জীবনের বাইরের দিকে ঘটনার ধারা চলিয়াছে, আর ভিতরের দিকে সঙ্গে সঙ্গে ছবি আঁকা চলিতেছে। দুয়ের মধ্যে যোগ আছে অথচ দু’ই ঠিক এক নহে।
আমাদের ভিতরের এই চিত্রপটের দিকে ভালো করিয়া তাকাইবার আমাদের অবসর থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে ইহার এক-একটা অংশের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু ইহার অধিকাংশই অন্ধকারে অগোচরে পড়িয়া থাকে। যে-চিত্রকর অনবরত আঁকিতেছে, সে যে কেন আঁকিতেছে, তাহার আঁকা যখন শেষ হইবে তখন এই ছবিগুলি যে কোন্ চিত্রশালায় টাঙাইয়া রাখা হইবে, তাহা কে বলিতে পারে।
কয়েক বৎসর পূর্বে একদিন কেহ আমাকে আমার জীবনের ঘটনা জিজ্ঞাসা করাতে, একবার এই ছবির ঘরে খবর লইতে গিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, জীবনবৃত্তান্তের দুই-চারিটা মোটামুটি উপকরণ সংগ্রহ করিয়া ক্ষান্ত হইব। কিন্তু দ্বার খুলিয়া দেখিতে পাইলাম, জীবনের স্মৃতি জীবনের ইতিহাস নহে– তাহা কোন্-এক অদৃশ্য চিত্রকরের স্বহস্তের রচনা। তাহাতে নানা জায়গায় যে নানা রঙ পড়িয়াছে, তাহা বাহিরের প্রতিবিম্ব নহে– সে-রঙ তাহার নিজের ভাণ্ডারের, সে-রঙ তাহাকে নিজের রসে গুলিয়া লইতে হইয়াছে– সুতরাং, পটের উপর যে-ছাপ পড়িয়াছে তাহা আদালতে সাক্ষ্য দিবার কাজে লাগিবে না।
এই স্মৃতির ভাণ্ডারে অত্যন্ত যথাযথরূপে ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা ব্যর্থ হইতে পারে কিন্তু ছবি দেখার একটা নেশা আছে, সেই নেশা আমাকে পাইয়া বসিল। যখন পথিক যে-পথটাতে চলিতেছে বা যে-পান্থশালায় বাস করিতেছে, তখন সে-পথ বা সে পান্থশালা তাহার কাছে ছবি নহে– তখন তাহা অত্যন্ত বেশি প্রয়োজনীয় এবং অত্যন্ত অধিক প্রত্যক্ষ। যখন প্রয়োজন চুকিয়াছে, যখন পথিক তাহা পার হইয়া আসিয়াছে তখনই তাহা ছবি হইয়া দেখা দেয়। জীবনের প্রভাতে যে-সকল শহর এবং মাঠ, নদী এবং পাহাড়ের ভিতর দিয়া চলিতে হইয়াছে, অপরাহ্নে বিশ্রামশালায় প্রবেশের পূর্বে যখন তাহার দিকে ফিরিয়া তাকানো যায়, তখন আসন্ন দিবাবসানের আলোকে সমস্তটা ছবি হইয়া চোখে পড়ে। পিছন ফিরিয়া সেই ছবি দেখার অবসর যখন ঘটিল, সেদিকে একবার যখন তাকাইলাম, তখন তাহাতেই মন নিবিষ্ট হইয়া গেল।
মনের মধ্যে যে-ঔৎসুক্য জন্মিল তাহা কি কেবলমাত্র নিজের অতীতজীবনের প্রতি স্বাভাবিক মমত্বজনিত। অবশ্য, মমতা কিছু না থাকিয়া যায় না, কিন্তু ছবি বলিয়াই ছবিরও একটা আকর্ষণ আছে। উত্তররামচরিতের প্রথম অঙ্কে সীতার চিত্তবিনোদনের জন্য লক্ষ্ণণ যে-ছবিগুলি তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহাদের সঙ্গে সীতার জীবনের যোগ ছিল বলিয়াই যে তাহারা মনোহর, তাহা সম্পূর্ণ সত্য নহে।
এই স্মৃতির মধ্যে এমন কিছুই নাই যাহা চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবার যোগ্য। কিন্তু বিষয়ের মর্যাদার উপরেই যে সাহিত্যের নির্ভর তাহা নহে; যাহা ভালো করিয়া অনুভব করিয়াছি, তাহাকে অনুভবগম্য করিয়া তুলিতে পারিলেই মানুষের কাছে তাহার আদর আছে। নিজের স্মৃতির মধ্যে যাহা চিত্ররূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাকে কথার মধ্যে ফুটাইতে পারিলেই, তাহা সাহিত্যে স্থান পাইবার যোগ্য।
এই স্মৃতিচিত্রগুলিও সেইরূপ সাহিত্যের সামগ্রী। ইহাকে জীবনবৃত্তান্ত লিখিবার চেষ্টা হিসাবে গণ্য করিলে ভুল করা হইবে। সে-হিসাবে এ লেখা নিতান্ত অসম্পূর্ণ এবং অনাবশ্যক।
জীবনস্মৃতি গুরুত্বপূর্ন অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর
২) জীবনস্মৃতি কবে রচিত হয়?
উঃ – জুলাই, ১৯১২।
৩) জীবনস্মৃতি’ প্রথম প্রকাশিত হয়
উঃ – ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ভাদ্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ থেকে শ্রাবণ, ১৩১৯ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত।
৪) গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ছবি ছিল
উঃ – ২৪টি।
৫) গ্রন্থের ছবিগুলি অঙ্কন করেছেন
উঃ – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৬) তৎকালীন ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন
উঃ – চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন –
“তোমার হাতেই জীবন সমর্পন করা গেল। রামানন্দবাবুকে লিখেছি। কিন্তু অজিতের (অজিতকুমার চক্রবর্ত্তী) প্রবন্ধ শেষ হয়ে গেলে এটা আরম্ভ হলে ভালো হয়। লেখকের তখন জীবন সম্বন্ধে ঔৎসুক্য একটু বাড়তে পারে।”
(১৩ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৮)
‘৭) জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে মোট পর্ব সংখ্যা
উঃ – ৪৫টি।
৮) গ্রন্থের পর্বের নাম কি?
উঃ – প্রথম – সূচনা, শেষ পর্ব – কড়ি ও কোমল।
৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি গ্রন্থে আধনিক ভারতের ইতিহাস রচনায়,“জীবন স্মৃতি”-র গুরুত্ব আলােচনা করাে।
উ: আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবন স্মৃতি’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গ্রন্থটি প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল । পরে তা ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। নিজের কথা বলার জন্যই রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মচরিত লেখেন ।
তবুও তার থেকে আমারা তখনকার দিনের অনেক কথাই জানতে পারি –
১০) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি গ্রন্থে ঠাকুরবাড়ির ও তখনকার দিনের বিভিন্ন বড়ােবাড়ির ছেলেদের বিবরণ:-
উঃ – এই স্মৃতি কথা থেকে ঠাকুর বাড়ি সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়।
ঠাকুর বাড়ির পরিবেশ কেমন ছিল তার খুঁটিনাটি বিবরণ তিনি দিয়েছেন। কীভাবে তার সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল, সেকথাও তিনি বলেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্য সংক্রান্ত নানা তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে জীবন স্মৃতির পাতায় পাতায়। জীবন স্মৃতি’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম জীবনের স্মৃতির সূত্র ধরে বাল্য জীবনের ঘরােয়া পরিবেশ ও সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন।
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মতাে অভিজাত পরিবারের সন্তানরা, বাল্যকালে মা- বাবা – গুরুজনদের প্রতিপালক রূপে পাননি। তারা মূলত পরিচালকদের তত্ত্বাবধানে বড়াে হয়ে উঠতেন। অন্যান্য ঘরের কাজে নিযুক্ত লােকজন ছােটদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাত |
ঠাকুর বাড়ির এই বিষয়টি তৎকালীন সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৈশিষ্ট্যকেই সূচিত করে।
১১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি গ্রন্থে কলকাতা শহরের বিবরণ:-
উঃ – জীবন স্মৃতি ‘ গ্রন্থে শহর কলকাতার বাবু শৌখিনতার পাশাপাশি পল্লী স্বভাবের চিহ্নও ধরা পড়ে কলকাতার
বিভিন্ন উৎসবের কথাও রয়েছে এই গ্রন্থে।
১২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি গ্রন্থে স্বাদেশিকতা:-
উঃ – রাজনীতির কথা সেভাবে কবি লেখেননি। কিন্তু স্বল্প পরিসরে ‘স্বাদেশিকতা’ নিয়ে সরস ভাষায় যে অনবদ্য
রচনা তিনি লিখেছেন, তা ইতিহাসের যেকোনাে ছাত্রকে মুগ্ধ না করে পারে না | স্বাদেশীকতার আবেগ নিয়ে এত সুন্দর ও মজার বর্ণনা আর কোথাও পাওয়া যায় না |
১৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি গ্রন্থের উপসংহার
উঃ – ইতিহাসের উপাদান হিসেবে জীবন স্মৃতি যে ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকরা কতটা কাজে লাগাবে, তা নিয়ে
বিশ্বকবি নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তার ভাষায় “ এই স্মৃতি ভাণ্ডারে অত্যন্ত যথাযথভাবে ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা ব্যর্থ হইতে পারে …” কিন্তু যতটুকু পাওয়া যায়, তার মূল্যও ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে অপরিসীম।
১৪) রবি ঠাকুরের বাঘ শিকার করার কাহিনী আলোচনা কর??
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মাঝেমধ্যেই জমিদারির কাজ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন হিমালয়ের পথে। সেবার হিমালয়ে যাওয়ার আগে জমিদারি দেখার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন পঞ্চম ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। দেবেন্দ্রনাথ ছেলেকে বলে গেলেন - কলকাতায় বসে জমিদারি দেখা চলবে না। যেতে হবে শিলাইদহে।
সে সময়ে শিলাইদহের জমিদারিতে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে গোলমাল চলছিল। যাই হোক, পিতার আদেশমত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চললেন শিলাইদহ। সঙ্গে নিলেন ছোটো ভাই রবিকে। সদ্য আড়াই মাস আগে দেবেন্দ্রনাথের সাথে শিলাইদহ থেকে ঘুরে গেছিলেন রবি। তাও আবার চললেন। কারণ শাসনহীন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিল রবি ঠাকুরের কাছে খুবই আদরের। রবি জানতেন শিলাইদহে তাঁকে শাসন করার কেউ নেই। বেশ মজা হবে।
রবি ও তার জ্যোতিদাদা পৌঁছোলেন শিলাইদহ। উঠলেন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। বয়সের পার্থক্য থাকলেও 'জ্যোতিদাদা'র সঙ্গে রবির সম্পর্কটা ছিল অনেকটাই বন্ধুর মত।
শিলাইদহে ছোট্ট রবি অনেকটা সময় কবিতা লিখতেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি রবি বের হতেন ঘোড়ায় চড়ে। আর ঘুরে বেড়াতেন শিলাইদহের এদিকসেদিক। জ্যোতিদাদা নিজেও ঘোড়ায় চড়া খুব পছন্দ করতেন। জ্যোতিদাদা চড়তেন বড় ঘোড়ায় আর রবি চড়তেন টাট্টু ঘোড়ায়। ঘোড়ায় চড়ে রবি সোজা চলে যেতেন শিলাইদহের রথতলার বড়ো মাঠে। মাঠটি ছিল রবির খুব প্রিয় জায়গা।
শিলাইদহের নামকরা শিকারী ছিলেন বিশ্বনাথ। তিনি মাঝেমাঝেই আসতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে। বিশ্বনাথ শিকারীর কাছে শিকারের গল্প শুনে শুনে শিকারের প্রতি প্রবল আগ্রহ তৈরি হয় দু'ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের মনে।
শিলাইদহের জঙ্গলে তখন মাঝে মাঝে বাঘ পড়ত। বিশ্বনাথ শিকারী একদিন এসে দু'ভাইকে খবর দিল যে শিলাইদহের জঙ্গলে বাঘ এসেছে। বাঘ-শিকারের ইচ্ছা জ্যোতিদাদার মনে আগে থেকেই ছিল। ব্যাস! বন্দুক বাগিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তৈরি হলেন বাঘ শিকারের জন্য। সাথে নিলেন ছোট্ট রবিকেও।
১৫) ঠাকুরবাড়ির ও তখনকার দিনের বিভিন্ন বড়ােবাড়ির ছেলেদের বিবরণ দাও।
এই স্মৃতি কথা থেকে ঠাকুর বাড়ি সম্পর্কে নানা তথ্য
পাওয়া যায়।ঠাকুর বাড়ির পরিবেশ কেমন ছিল তার খুঁটিনাটি বিবরণ তিনি দিয়েছেন। কীভাবে তার সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল, সেকথাও তিনি বলেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্য সংক্রান্ত নানা তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে জীবন স্মৃতির পাতায় পাতায়। জীবন স্মৃতি' গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম জীবনের স্মৃতির সূত্র ধরে বাল্য জীবনের ঘরােয়া পরিবেশ ও সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন।
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মতাে অভিজাত পরিবারের সন্তানরা, বাল্যকালে মা- বাবা গুরুজনদের প্রতিপালক রূপে পাননি। তারা মূলত পরিচালকদের তত্ত্বাবধানে বড়াে হয়ে উঠতেন।
অন্যান্য ঘরের কাজে নিযুক্ত লােকজন ছােটদের ওপর
কর্তৃত্ব ফলাত | ঠাকুর বাড়ির এই বিষয়টি তৎকালীন সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৈশিষ্ট্যকেই সূচিত করে।
১৬) ভৃত্যরাজক তন্ত্র সম্পর্কে যা জান লেখ।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে দাসরাজাদের রাজত্বকাল সুখের কাল ছিল না। আমার জীবনের ইতিহাসেও ভৃত্যদের শাসনকালটা যখন আলোচনা করিয়া দেখি তখন তাহার মধ্যে মহিমা বা আনন্দ কিছুই দেখিতে পাই না। এই-সকল রাজাদের পরিবর্তন বারংবার ঘটিয়াছে কিন্তু আমাদের ভাগ্যে সকল-তা’তেই নিষেধ ও প্রহারের ব্যবস্থার বৈলক্ষণ্য ঘটে নাই। তখন এ-সম্বন্ধে তত্ত্বালোচনার অবসর পাই নাই— পিঠে যাহা পড়িত তাহা পিঠে করিয়াই লইতাম এবং মনে জানিতাম সংসারের ধর্মই এই— বড়ো যে সে মারে, ছোটো যে সে মার খায়। ইহার বিপরীত কথাটা, অর্থাৎ ছোটো যে সেই মারে,বড়ো যে সেই মার খায়— শিখিতে বিস্তর বিলম্ব হইয়াছে।
কোন্টা দুষ্ট এবং কোন্টা শিষ্ট, ব্যাধ তাহা পাখির দিক হইতে দেখে না, নিজের দিক হইতেই দেখে। সেইজন্য গুলি খাইবার পূর্বেই যে সতর্ক পাখি চীৎকার করিয়া দল ভাগায়, শিকারী তাহাকে গালি দেয়। মার খাইলে আমরা কাঁদিতাম, প্রহারকর্তা সেটাকে শিষ্টোচিত বলিয়া গণ্য করিত না। বস্তুত, সেটা ভৃত্যরাজদের বিরুদ্ধে সিডিশন। আমার বেশ মনে আছে, সেই সিডিশন সম্পূর্ণ দমন করিবার জন্য জল রাখিবার বড়ো বড়ো জালার মধ্যে আমাদের রোদনকে বিলুপ্ত করিয়া দিবার চেষ্টা করা হইত। রোদন জিনিসটা প্রহারকারীর পক্ষে অত্যন্ত অপ্রিয় এবং অসুবিধাজনক, এ-কথা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবে না।
এখন এক-একবার ভাবি, ভৃত্যদের হাত হইতে কেন এমন নির্মম ব্যবহার আমরা পাইতাম। মোটের উপরে আকারপ্রকারে আমরা যে স্নেহদয়ামায়ায় অযোগ্য ছিলাম তাহা বলিতে পারি না। আসল কারণটা এই, ভৃত্যদের উপরে আমাদের সম্পূর্ণ ভার পড়িয়াছিল। সম্পূর্ণ ভার জিনিসটা বড়ো অসহ্য। পরমাত্মীয়ের পক্ষেও দুর্বহ। ছোটো ছেলেকে যদি ছোটো ছেলে হইতে দেওয়া যায়— সে যদি খেলিতে পায়, দৌড়িতে পায়, কৌতুহল মিটাইতে পারে, তাহা হইলেই সে সহজ হয়। কিন্তু যদি মনে কর, উহাকে বাহির হইতে দিব না, খেলায় বাধা দিব, ঠাণ্ডা করিয়া বসাইয়া রাখিব, তাহা হইলে অত্যন্ত দুরূহ সমস্যার সৃষ্টি করা হয়। তাহা হইলে, ছেলেমানুষ ছেলেমানুষির দ্বারা নিজের যে-ভার নিজে অনায়াসেই বহন করে সেই ভার শাসনকর্তার উপড়ে পড়ে। তখন ঘোড়াকে মাটিতে চলিতে না দিয়া তাহাকে কাঁধে লইয়া বেড়ানো হয়। যে-বেচারা কাঁধে করে তাহার মেজাজ ঠিক থাকে না। মজুরির লোভে কাঁধে করে বটে, কিন্তু ঘোড়া-বেচারার উপর পদে পদে শোধ লইতে থাকে।
এই আমাদের শিশুকালের শাসনকর্তাদের মধ্যে অনেকেরই স্মৃতি কেবল কিলচড় আকারেই মনে আছে— তাহার বেশি আর মনে পড়ে না।
১৭) নিজের শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কি বলেছেন?
তখন নর্মাল স্কুলের একটি শিক্ষক, শ্রীযুক্ত নীলকমল ঘোষাল মহাশয় বাড়িতে আমাদের পড়াইতেন। তাঁহার শরীর ক্ষীণ শুষ্ক ও কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ম ছিল। তাঁহাকে মানুষজন্মধারী একটি ছিপ্ছিপে বেতের মতো বোধ হইত। সকাল ছটা হইতে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাভার তাঁহার উপর ছিল। চারুপাঠ, বস্তুবিচার, প্রাণিবৃত্তান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া মাইকেলের মেঘনাদবধকাব্য পর্যন্ত ইঁহার কাছে পড়া। আমাদিগকে বিচিত্র বিষয়ে শিক্ষা দিবার জন্য সেজদাদার৩ বিশেষ উৎসাহ ছিল। ইস্কুলে আমাদের যাহা পাঠ্য ছিল বাড়িতে তাহার চেয়ে অনেক বেশি পড়িতে হইত। ভোর অন্ধকার থাকিতে উঠিয়া লংটি পরিয়া প্রথমেই এক কানা পালোয়ানের৪ সঙ্গে কুস্তি করিতে হইত। তাহার পরে সেই মাটিমাখা শরীরের উপরে জামা পরিয়া পদার্থবিদ্যা, মেঘনাদবধকাব্য, জ্যামিতি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল শিখিতে হইত। স্কুল হইতে ফিরিয়া আসিলেই ড্রয়িং এবং জিম্নাস্টিকের মাস্টার আমাদিগকে লইয়া পড়িতেন। সন্ধ্যার সময় ইংরেজি পড়াইবার জন্য আঘোরবাবু আসিতেন। এইরূপে রাত্রি নটার পর ছুটি পাইতাম।
রবিবার সকালে বিষ্ণুর৫ কাছে গান শিখিতে হইত। তা ছাড়া প্রায় মাঝে মাঝে সতীনাথ দত্ত৬ মহাশয় আসিয়া যন্ত্রতন্ত্রযোগে প্রাকৃতবিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। এই শিক্ষাটি আমার কাছে বিশেষ ঔৎসুক্যজনক ছিল। জ্বাল দিবার সময় তাপসংযোগে পাত্রের নীচের জল পাতলা হইয়া উপরে উঠে, উপরের ভারী জল নীচে নামিতে থাকে, এবং এইজন্যই জল টগবগ করে— ইহাই যেদিন তিনি কাচপাত্রে জলে কাঠের গুঁড়া দিয়া আগুনে চড়াইয়া প্রত্যক্ষ দেখাইয়া দিলেন সেদিন মনের মধ্যে যে কিরূপ বিস্ময় অনুভব করিয়াছিলাম তাহা আজও স্পষ্ট মনে আছে। দুধের মধ্যে জল জিনিসটা যে একটা স্বতন্ত্র বস্তু, জ্বাল দিলে সেটা বাষ্প আকারে মুক্তিলাভ করে বলিয়াই দুধ গাঢ় হয়, এ কথাটাও যেদিন স্পষ্ট বুঝিলাম সেদিনও ভারি আনন্দ হইয়াছিল। যে-রবিবারে সকালে তিনি না আসিতেন, সে-রবিবার আমার কাছে রবিবার বলিয়াই মনে হইত না।
ইহা ছাড়া, ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলের একটি ছাত্রের কাছে কোনো-এক সময়ে অস্থিবিদ্যা শিখিতে আরম্ভ করিলাম। তার দিয়া জোড়া একটি নরকঙ্কাল৭ কিনিয়া আনিয়া আমাদের ইস্কুলঘরে লটকাইয়া দেওয়া হইল।
ইহারই মাঝে এক সময়ে হেরম্ব তত্ত্বরত্ন মহাশয় আমাদিগকে একেবারে ‘মুকুন্দং সচ্চিদানন্দং’ হইতে আরম্ভ করিয়া মুগ্ধবোধের সূত্র মুখস্থ করাইতে শুরু করিয়া দিলেন। অস্থিবিদ্যার হাড়ের নামগুলা এবং বোপদেবের সূত্র, দুয়ের মধ্যে জিত কাহার ছিল তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারি না। আমার বোধ হয় হাড়গুলিই কিছু নরম ছিলো না।
১৮) পিতৃদেব সম্পর্কে রবির অনুভূতি ও আবেগ আলোচনা কর।
আমার জন্মের কয়েক বৎসর পূর্ব হইতেই আমার পিতা১ প্রায় দেশভ্রমণেই নিযুক্ত ছিলেন। বাল্যকালে তিনি আমার কাছে অপরিচিত ছিলেন বলিলেই হয়। মাঝে মাঝে তিনি কখনো হঠাৎ বাড়ি আসিতেন; সঙ্গে বিদেশী চাকর লইয়া আসিতেন; তাহাদের সঙ্গে ভাব করিয়া লইবার জন্য আমার মনে ভারি ঔৎসুক্য হইত। একবার লেনু বলিয়া অল্পবয়স্ক একটি পাঞ্জাবি চাকর তাঁহার সঙ্গে আসিয়াছিল। সে আমাদের কাছে যে-সমাদরটা পাইয়াছিল তাহা স্বয়ং রণজিতসিংহের পক্ষেও কম হইত না। সে একে বিদেশী তাহাতে পাঞ্জাবি— ইহাতেই আমাদের মন হরণ করিয়া লইয়াছিল। পুরাণে ভীমার্জুনের প্রতি যেরকম শ্রদ্ধা ছিল, এই পাঞ্জাবি জাতের প্রতিও মনে সেই প্রকারের একটা সম্ভ্রম ছিল। ইহারা যোদ্ধা— ইহারা কোনো কোনো লড়াইয়ে হারিয়াছে বটে, কিন্তু সেটাকেও ইহাদের শত্রুপক্ষেরই অপরাধ বলিয়া গণ্য করিয়াছি। সেই জাতের লেনুকে ঘরের মধ্যে পাইয়া মনে খুব একাট স্ফীতি অনুভব করিয়াছিলাম। বউঠাকুরাণীর২ ঘরে একটা কাচাবরণে-ঢাকা খেলার জাহাজ ছিল, তাহাতে দম দিলেই রঙকরা কাপড়ের ঢেউ ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিত এবং জাহাজটা আর্গিন-বাদ্যের সঙ্গে দুলিতে থাকিত। অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া এই আশ্চর্য সামগ্রীটি বউ-ঠাকুরানীর কাছ হইতে চাহিয়া লইয়া, প্রায় মাঝে মাঝে এই পাঞ্জাবিকে চকৎকৃত করিয়া দিতাম। ঘরের খাঁচায় বদ্ধ ছিলাম বলিয়া যাহা-কিছু বিদেশের, যাহা-কিছু দূরদেশের, তাহাই আমার মনকে অত্যন্ত টানিয়া লইত। তাই লেনুকে লইয়া ভারি ব্যস্ত হইয়া পড়িতাম। এই কারণেই গাব্রিয়েল বলিয়া একটি য়িহুদি তাহার ঘুন্টি-দেওয়া য়িহুদি পোশাক পরিয়া যখন আতর বেচিতে আসিত, আমার মনে ভারি একটা নাড়া দিত, এবং ঝোলাঝুলিওয়ালা ঢিলাঢালা ময়লা পায়জামা-পরা বিপুলকায় কাবুলিওয়ালাও আমার পক্ষে ভীতিমিশ্রিত রহস্যের সামগ্রী ছিল।
যাহা হউক, পিতা যখন আসিতেন আমরা কেবল আশপাশ হইতে দূরে তাঁহার চাকরবাকরদের মহলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কৌতূহল মিটাইতাম। তাঁহার কাছে পৌঁছানো ঘটিয়া উঠিত না।
১৯) ইতি মধ্যে বাড়িতে পর পর কয়েকটি মৃত্যু ঘটনা ঘটিল - আলোচনা কর।
ইতিমধ্যে বাড়িতে পরে পরে কয়েকটি মৃত্যুঘটনা ঘটিল। ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনোদিন প্রত্যক্ষ করি নাই। মা’ র যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অল্প।১ অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়— তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে।” তখনই বউঠাকুরানী২ তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন— পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল।
MORE RELATED POSTS
উপভাষা কাকে বলে? কয় প্রকার ও কি কি?? তাদের সীমানা নির্ধারণ কর।
ভাষা কাকে বলে? ভাষার বৈশিষ্ট্য ও অংশ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য 1st semester 1 ও 2 paper suggetion
পারিভাষিক শব্দ কি বা কাকে বলে | পারিভাষিক শব্দের প্রয়োজনীয়তা ও পরিভাষা তালিকা
ধ্বনি পরিবর্তনের রীতি | dhoni poribortoner riti mcq|primary TET
ভারতীয় ভাষা পরিষদ l Bhartiya -arya Bhasha
জীবনস্মৃতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । rabindra nath tagor jibon sriti
বরেন্দ্রী উপভাষার অঞ্চল বা এলাকা উল্লেখ করে এই উপভাষার রূপতাত্ত্বিক ও ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লেখ।
সামাজিক গোষ্ঠীর সংজ্ঞা , বৈশিষ্ট ও গুরুত্ব
প্রাথমিক গোষ্ঠী ও গৌণ গোষ্ঠীর পার্থক্য গুলো আলোচনা কর।
সামাজিকীকরণ কি l samajikikoron ki সামাজিকীকরণ কি l samajikikoron ki l সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা
prathomik ghostir songa o boisisto in bengali l প্রাথমিক গোষ্ঠীর ধারণা , বৈশিষ্ট ও গুরুত্ব।
সামাজিক পরিবর্তন কাকে বলে? সামাজিক পরিবর্তনের উপাদানসমূহ আলোচনা করো।
সামাজিক স্তরবিন্যাস কী? সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধরন কী কী?
সামাজিক পরিবর্তনের কারণসমূহ আলােচনা কর।
বর্ণপ্রথার বৈশিষ্ট্য কী? 'বর্ণ' ও ‘জাতি'-র ধারণার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর।
B.A. (Hons.) Bengali, Bachelor of Arts Honours in Bengali, Syllabu…
WB TET Preparation Tips 2023, Study Material
Philosophy Short Essay Questions | My Best Writer
Videosহাট্টিমাটিম টিম - Hattimatim Tim and more | Bengali Rhymes Collection -1
করোনা l coronavirus l সময়ে বিদ্যালয়ের অবস্থা । পার্ট-1
করোনা l coronavirus l সময়ে বিদ্যালয়ের অবস্থা । পার্ট -2
Classes
Mock Tests
Crack Exams
Website Links click here
Terms & Conditions Privacy Policy
STUDY CARE
Whatsapp Ask a Doubt
Studycare0365.blogspot.com
Jangipur,Murshidabad
West Bengal, 742213
Call +91 7908497874
Kajemshaikh0365@gmail.com
Site Links
• About Us
Top Exams
• UPSC Exams
• Teaching Jobs
• Railway Exams
• Banking Exams
Comments
Post a Comment
If you have any doubts, let me know or write us Kajemshaikh0365@gmail.com